প্রতিবেশী

avatar
(Edited)

"প্রতিবেশী" শব্দটা আমাদের কাছে তিক্ততার মনে হলেও এর গভীরতা আমি মধুর হিসেবেই নেই। প্রতিবেশী শব্দ টা দেখেই নিশ্চয়ই আপনার ভেতরে নানা রকমের অভিযোগ তৈরি হয়েছে। অথবা আপনার নিজের মধ্যে একটি বিরক্তকর চেহারা ফুটে উঠেছে। হয়তো এটা অস্বাভাবিক কিছু না। কারণ আমিও মাঝেমধ্যে এই শব্দটা নিয়ে বিরক্ত প্রকাশ করি। যখন জানতে পারি কোন প্রতিবেশী অন্য কারো ক্ষতি করেছে অথবা কেউ নিজের জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে যে পাশের বাসায় কি ঘটনা ঘটতে চলেছে। প্রতিবেশীর সাথে মনে হয় আমরা এভাবেই বেশি পরিচিত।

যখন থেকে ঢাকায় চলে আসা তখন থেকেই নিজের আত্মীয়-স্বজনদের বছরেও একবার দেখা মেলা ভার। খুব বেশি হলে ফোনের মাধ্যমে জানা হয় তাদের দিনকাল কেমন চলছে। কোন অনুষ্ঠান অথবা ঈদের সময় একমাত্র তাদের দেখা মিলে। আমাদের সব থেকে কাছের মানুষগুলোও যখন দূরে চলে যায় অজান্তেই আমাদের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে যায়। নতুন নতুন কিছু দিন ভালই প্রতিনিয়ত ফোনে যোগাযোগ হয়। কিন্তু সময় যত বাড়তে থাকে যোগাযোগের হিসেবটাও কমতে থাকে। তারপরও হয়তো মাসে একবার কথা বলা হয়। সময় যত বাড়বে যোগাযোগের মাত্রাটাও তত কমতে থাকে, তারপর একটা সময় বছরেও আর তাদের সাথে কথা বলা সম্ভব হয় না।

শুধুমাত্র আত্মীয়-স্বজনের দোষ দিলে ভুল হবে। দূরত্ব বাড়ার সাথে সাথে আমরাও ধীরে ধীরে যোগাযোগ কমিয়ে দেই। গ্রাম ছেড়ে যখন আমি আমার পরিবারকে নিয়ে শহরে চলে আসি তখন এখানেই নিজেদের নতুন একটি জীবন তৈরি হয়। আশেপাশে যত দূর তাকাই সবই অচেনা লাগে। আমাদের ঢাকায় খুব বেশি আত্মীয়-স্বজন নেই। 'খুব বেশি' বললে ভুল হবে একেবারে নেই বললেই চলে। প্রথম প্রথম মনে হতো কেউ হয়তো আর আপন হবে না। কোন বন্ধুও হবে না নতুন অথবা আমাদের কথা বলার জন্য কোন মানুষ থাকবে না। কিন্তু সত্যি বলতে যত সময় গেল আশেপাশের মানুষগুলো কেমন আপন হয়ে গেল। যেকোনো মুহূর্তেই যে কোন সমস্যায় সবার প্রথমে প্রতিবেশীরাই ছুটে এসেছে।

আত্মীয়-স্বজনদের ফোন করতে করতে এবং তাদের আসতে আসতে অনেক সময় চলে গিয়েছে। প্রতিবেশীরা থাকাতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি সেই সময়টাতে। প্রায় এক বছর আগের ঘটনা। আমার বাবা মাত্র অবসর হয়েছিল। তখন হঠাৎ করেই বাবা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। আমার বড় ভাইও চট্টগ্রাম থাকে আর বড় বোন সে নিজের শ্বশুর বাড়ি। বাসায় শুধু আমি আর আমার "মা" ই ছিলাম। হঠাৎ করে বাবা যখন অসুস্থ হয়ে যায় বুঝতে পারছিলাম না কি করা উচিত। আমার বাবার তখন কিডনির সমস্যা হয়েছিল। তার কিডনিতে পাথর হওয়ার কারণে প্রচন্ড ব্যথা শুরু হয়। যদিও আমাদের সেটা জানা ছিল না। হঠাৎ করেই যখন ব্যথা শুরু হয় আমি আর আম্মু ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।

আম্মু দরজা খুলেই ছুটে যায় আমাদের পাশের বাসায়। যখন পাশের বাসার আন্টি জানতে পারে দৌড়ে এসে দেখে আব্বু বিছানায় ব্যথায় ছটফট করছে। তিনি তার দুই ছেলেকে ডেকে একজনকে গাড়ি আনতে পাঠালো আর অন্য জন আমার বাবাকে ধরে দাঁড় করালো। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি সিএনজি আমাদের বাসার সামনে এসে দাঁড়ায়। আপনি জানলে অবাক হবেন তারপরে তারা নিজেরাই আমার বাবাকে হসপিটালে নিয়ে যায়। আমাকে বাসায় রেখে যায় এবং সাথে আম্মু যায়। পরে আমাকে ফোন করে জানানো হয় যে তার কিডনিতে পাথর হয়েছে, যার জন্য প্রচন্ড ব্যথা শুরু হয়েছিল। আব্বুকে দুই দিনের জন্য হসপিটালে ভর্তি করায় এবং বলা হয় যে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অপারেশন করাতে হবে।

ভাই বোন দুইজনই দূরে থাকার কারণে কেউই সেই সময়টাতে সাথে সাথে আসতে পারেনি। অবশ্য একদিন পরে তারা দুই জনই আসে। কিন্তু তারপরেও প্রতিবেশীরা আমাদের পাশে থাকার কারণে খুব বেশি কিন্তু অসুবিধে হয়নি। যত রকম সাহায্যের প্রয়োজন ছিল আশেপাশের সবাই সাহায্য করেছে। কিছুক্ষণ পরপরই এসে কেউ না কেউ আমার আব্বুর কথা জিজ্ঞেস করেছে যে তিনি এখন কেমন আছেন? এই সাধারণ প্রশ্নটাই তখন আমাদের মনে বেশ আনন্দ দিচ্ছিল। প্রতিনিয়ত তারা আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের কষ্টটাকে হালকা করে দিচ্ছিল। তাদের সাথে যে খুব বেশি মধুর সম্পর্ক ছিল ঠিক তা না।

মাঝেমধ্যেই খুব সাধারণ বিষয় নিয়ে তাদের সাথে ঝগড়াঝাঁটি হত। কিন্তু তারপরেও যেকোন অসুবিধা হতো আমার পরিবারে, সবথেকে তারাই আগে আসত। আমি মনে করি প্রতিবেশীরা আমাদের আত্মীয়-স্বজন থেকেও অনেক বড়। আমার আম্মু সব সময় বলতো যে কোন বিপদে আত্মীয়স্বজন আসতে না পারলেও প্রতিবেশীরা সবার আগে আসে। প্রতিবেশীদের সাথে খুব বেশি আন্তরিক সম্পর্কের প্রয়োজন হয় না। আপনি যখন যেকোন সমস্যায় পড়বেন আপনি সবার আগে প্রতিবেশীদেরই নিজের পাশে পাবেন। এটা আমাদের সামাজিক পরিবার। এর জন্যই হয়তো আমরা সমাজ ছাড়া চলতে পারি না।

প্রতিবেশীরা আমাদের প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দেয় যে, রক্তের সম্পর্ক ছাড়াও আরো কিছু সম্পর্ক তৈরি হয়। যারা সকল বিপদ-আপদে পাশে এসে দাঁড়ায়। আমাদের সকল দুঃখ-কষ্টে তারাই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়।

IMG_20220730_185736.jpg



0
0
0.000
6 comments
avatar

প্রতিবেশীরা আমাদের প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দেয় যে, রক্তের সম্পর্ক ছাড়াও আরো কিছু সম্পর্ক তৈরি হয়। যারা সকল বিপদ-আপদে পাশে এসে দাঁড়ায়।

এ জিনিসটা স্রস্টা প্রদত্ত একটি গুন, কেননা যদি মায়া মমতা, সহমর্মিতা পৃথিবী থেকে উঠে যেত তাহলে এ পৃথিবীর চেহারা অন্যরকম দেখতে হতো। আপনার জন্য দোয়া করি, যেন বিপদ থেকে দূরে থাকতে পারেন, 👍💝।

0
0
0.000
avatar

ঠিক বলেছেন ভাইয়া, এখনো আমাদের মধ্যে মায়া-মমতা রয়েছে দেখেই হয়তো পৃথিবীটা এখনো টিকে রয়েছে।

ধন্যবাদ।

0
0
0.000
avatar

শহরের প্রতিবেশী আর গ্রামের প্রতিবেশী আলাদা।গ্রামের প্রতিবেশীদের মধ্যে যোগাযোগ, আদানপ্রদান বেশি হয় সম্পর্ক ভালো থাকে।কিন্তু শহরের প্রতিবেশীদের মধ্যে তেমন যোগাযোগ থাকে না বেশিরভাগ ক্ষেত্রে।

কিন্তু তারপরও বেশিদিন একি বাসায় থাকলে অনেক প্রতিবেশীর সাথে ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়।
অবশ্যে ধর্মেও প্রতিবেশী সম্পর্কে খুব জোড়ালো গুরুত্বারুপ করা হয়েছে।

0
0
0.000
avatar

কিন্তু তারপরও বেশিদিন একি বাসায় থাকলে অনেক প্রতিবেশীর সাথে ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়।

শহরে কারো সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে একটু বেশি সময় দিতে হয়। কারণ শহরে কেউ খুব বেশি নিজের বাসা থেকে বের হতে চায় না। যার কারণে প্রতিবেশীর সাথে দেখা খুব কম হয়।

0
0
0.000