কৃষ্ণচূড়া আর সোনালুর দ্যাশেঃ বিদায়
সকাল সকাল মাসিমা'র বানানো গরম গরম লুচি, আলুর দম, আর পায়েস খেয়ে আমরা বাগেরহাটের বাস ধরলাম, গন্তব্য ষাট-গম্বুজ মসজিদ।


সোনালু আর কৃষ্ণচূড়ার অভ্যর্থনায় পৌঁছে গেলাম ঘন্টা দেড়েকের মধ্যেই।

প্রধান ফটক

ভাবলেই মাথা ঘুরে যায় যে, পনের শতাব্দীতে বানানো বঙ্গের এই ইমারত এখনো কি দাম্ভিকতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই একবিংশ শতাব্দীতেও!


বিশাল মসজিদের সুউচ্চ খিলানের মাঝে হারিয়ে যাওয়া যাকে বলে।


প্রচন্ড খরতাপে ঘুরে ফিরে যেয়ে মসজিদের পেছনে ঘোড়াদীঘি'র শান বাঁধানো ঘটে বসলাম খানিক্ষন।

দীঘিতে সড়সড় করে নেমে যাবার ইচ্ছে দমন করলাম বহু কষ্টে। শৈলী তবুও পা ভিজতে পেরেছিল।
ওখান থেকেই ফারদিন আপু বললেন উনি খান জাহান আলীর মাজারে যেতে চান, সেখানেও যাওয়া হলো।

মাজারে ক'জন ভন্ড-মুরীদেরও দেখা পাওয়া গেল। তবে অবাক লাগলো মাজারের পিছনে কালো পাথরে ঢাকা প্রায় ৫ ফুট উঁচু একটা কবর, যেটার চারপাশ আবার মোটা গারদে বেষ্টিত।
জানা গেলোনা সে রহস্যময় কবরের অধিকারী বা কারিনী কে!
সব পরিকল্পনা মতোই হচ্ছিল।
যেহেতু আমরা আবার খুলনা যেয়ে চুই-ঝালের গোস্ত দিয়ে ভাত খেতে হবে আর খেয়েই শিব-মন্দির দেখতে যেতে হবে আলো থাকতেই, তাই দুপুরের আগেই এসব দেখে খুলনা চলে যেতে হবে।
কিন্তু এই কাহিনী শুনেই বেশ রোমাঞ্চিত বোধ করলাম এই ভেবে যে, সেখানে বুঝি চন্দ্রমুখী'র ভূতের দেখা মিলবে বা নিদেনপক্ষে কোনো এক রোমাঞ্চকর গল্পের সন্ধান পাব।
যদিও, এটা আমাদের পরিকল্পনার বাইরে, এবং বেশ ভেতরের দিকে, একটু চিন্তা হলেও সময় নিয়ে, কৌতূহলেরই জয় হলো!
তবে সেখানে গেলে গাড়ি রিজার্ভ করে যেতে হবে, কারণ স্থানের একদম ভেতরে সেই মহলের নির্মাণ।

কিন্তু যেয়ে দেখলাম আসল কাহিনী একেবারেই অন্য।
শাহজাহান, মমতাজের জন্য তাজমহল বানিয়েছিল, অরে আমাদের দেশের এক প্রবাসী ভদ্রলোক বানিয়েছে তার স্ত্রীর নাম চন্দ্রমহল! তবে তার রুচি থেকে সে যথেষ্ট চেষ্টা করেছে বোঝা যায় জিনিসটাকে তাজমহলের মতো একটা আবহ দিতে।
কিন্তু অদ্ভুত এক জগাখিচুড়ি তাতে।
গেটের দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়বে কর্ণেল এম.এ.জি. ওসমানী, মাস্টারদা সূর্যসেন আর সুফিয়া কামালের একটা ভাস্কর্য। আবার অন্যান্য দিকে আরো কিছই ভাস্কর্য রেখেছে যাতে বাংলার আবহমান-বাংলার একটা ধারণা দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। আবার পাশেই চিড়িয়াখানার মতো একটা ছোট্ট জায়গায় কিছু পাখি, ময়ুর রাখা!
এই চন্দ্রমুখী'র ভূতের দেখা না পেলেও, এই ভৌতিক সংকলন দেখে খানিকটা ভয়ই লাগলো!
দরজা জানালা সব বন্ধ থাকায় আমরা জানালাগুলোয় উঁকিঝুঁকি মেরে ভেতরের সৌন্দর্যের পিপাসা নিবারণ করে আমরা বেরিয়ে এলাম।
এসেও আরেক কান্ড।
চন্দ্রমহল থেকে বের হয়ে ভ্যানে করে আমরা মেইনরোডে এলাম বাসে উঠবো বলে। সেখানে ভ্যানওয়ালা বললো, চাইলে এই ভ্যানে করে আপনারা রূপসা নদীর তীর অব্দি যেতে পারেন।
তখন প্রায় বোধহয় ঘড়িতে ১২টা।
প্রস্তাবটা আমার আর শৈলীর দারুন পছন্দ হলো।
ফারদিন আপু একটু দুশ্চিন্তিত ছিলেন অবশ্য এই অনাবশ্যক উচ্ছাস নিয়ে।

হাইওয়ে রাস্তা হলেও, খুলনা-সাতক্ষীরা সেই রাস্তা বেশ ফাঁকাই মনে হলো। তাছাড়া এরকম দু'পাশে সবুজে ছাওয়া রাস্তায় একটা ভ্যান/রিক্সা রাইড দারুন ব্যাপার, আবহাওয়াও বেশ নাতিশীতোষ্ণ।
যদিও ফারদিন আপুর এ ধরণের পাগলামিতে অনভ্যস্ততা আছে, তবুও আমরা তাকে নিম-রাজি করিয়ে তুললাম ভ্যানে।
দু'পাশে সবুজের সমারোহের মাঝে মাঝে উঁকি দেয়া লাল-টকটকে কৃষ্ণচুড়া আর কাঁচা হলুদের সোনালুদের অভ্যর্থনায় আমরা এগিয়ে চললাম আলোছায়ার মধ্যে।
একসময় ভ্যানওয়ালাকে ধরে বসলাম একটা অঞ্চলভিত্তিক গান গাওয়ার জন্য। বেচারা লজ্জায় প্রথমে রাজি না হলেও আমার নির্লজ্জ জোরাজুরিতে হার মেনে একটা গান লাজুক লাজুকভাবে গাইলো।
তারপর বাকি রাস্তা চললো আমাদের হেঁড়ে গলায় গান।
না, আমাদের বললে ভুল হবে, শুধু আমার।
আমার দুই সংগিনীর বোধহয় রেওয়াজের চর্চা ছিল, যা সুন্দর গাইলো।
তা শুনে আমার হেঁড়ে গলার স্বর লজ্জা না পেয়ে উল্টো চড়াও হলো!
আমরা গান গাইতে গাইতে লম্বা যাত্রা শেষে পৌঁছে গেলাম রূপসার তীরে। ঐযে বলেছিলাম, নদী, দূর থেকে মনে হয় সব নদীই একই, কিন্তু কাছে গেলে বোঝা যায় প্রত্যেকটা মানুষের মতোই নদীরও চেহারা আলাদা কাছে গেলে।
কিন্তু সময় স্বল্পতার কারণে রূপসার রূপ আহরণ করবার সুযোগ না থাকায় একবার চোখের দেখা দেখেই চলে গেলাম বাস ধরে খুলনা শহরে।
সোজা গিয়ে ঢুকলাম "আল আরাফাহ" রেস্তোরাঁয়।
গিয়েই বলা বাহুল্য বয়রাকে বললাম গরম ভাত আর চুই-ঝালের গরুর গোস্ত নিয়ে আসতে।

বয়রা দেখি একটা বিশাল স্টিলের গামলায় এক গামলা গরুর গোস্ত নিয়ে হাজির। তা দেখে যারপরনাই ঘাবড়ে গেলাম, যেন বিয়ে বাড়িতে খেতে এলাম মনে হলো। এরকম আপ্যায়নতো বিরল ব্যাপার রেস্তোরাঁয়।
জিজ্ঞেস করলো এখন থেকে যে টুকরাটি চাই সেটিই দেবে, এবং এক টুকরারই দাম রাখবে। শুনে হাঁফ ছাড়লাম, নইলেতো ভেবেছিলাম বুঝি পুরো গামলার গোস্তের দাম দিতে হবে।
আয়োজনটা বেশ পছন্দ হলো।
একেকবার মোঘলী কারবার।
আমাকে যদি বলা হয়, চট্টগ্রামের মেজবান, সিলেটের সাতকরা, আর খুলনার ছুঁই-ঝালের গরুর গোস্ত, কোনটি সেরা?
মেজবান জন্ম থেকেই স্বীয় মহিমায় হৃদয়ে নাম্বার-ওয়ান জায়গা দখল করে থাকলেও, মনে হলো সেই রেকর্ড খুলনায় এসে ভেঙে গেলো, এতই দারুণ লাগলো চুই-ঝালের গরুর গোস্ত।
প্রচন্ড ঝাল, নাকেমুখে-চোখে পানি আনার মতো, কিন্তু খাবার থেকে সংবরণ করা দুরহ।
All the contents are mine, until it’s mentioned. ```
language